ক্ষয় আরও গভীরে
নতুন কোয়ার্টারে এসে ঝাড়পোঁছ চলছিল। হঠাৎই বাঙ্কের
উপর থেকে নেমে এল বেশ কিছু পুরনো কাগজপাতি। আগে যারা থাকত তারাই ফেলে গেছে হয়তো।
কি সব একগুচ্ছ মেয়েলি ঘর সাজানো, সাজগোজ আর রান্নার ন্যাকা ন্যাকা ম্যাগাজিন। কি
করে যে মানুষ এসব দিনের পর দিন পড়ে!!
আরও ছিল কিছু আবোলতাবোল কাঁচা হাতের লেখা ভরা ডাইরি। মাঝে
মাঝে গোল, চৌকো, ত্যাবড়া-ধ্যাবড়া লাইন টানা ছবি আঁকা। হয়তো কোন বাচ্চা ছিল, যে
নিজের মত সাহিত্য চর্চা করেছিল এগুলোতে। বেশির ভাগ পাতাই তার খালি। ডাইরিগুলো তাই
আলাদা করেদিলাম; কাজের মেয়েকে দিয়ে দেব। তার ছেলেমেয়েগুলো ছোট, স্কুলে পড়ে। ফাঁকা
পাতাগুলো ওদের কাজে লেগে যাবে। সব কিছুর মাঝ থেকে বেরিয়ে এল একটা খাতা; বেশ কিছু
পাতা মাঝে মাঝে ছেঁড়া। যেন কেউ রেগে খাবলে ছিঁড়ে নিয়েছে। তবু বাকিটুকু পড়া যাচ্ছে।
বেশ সুন্দর ঝকঝকে হাতের লেখা। শুরুর দিকের পাতাগুলো মলিন হয়ে এলেও অস্পষ্ট নয়। হাল্কা
চোখ বুলিয়ে বুঝলাম এ খাতা শুধুই খাতা নয়; এই খাতা এক জীবনী, এক চলচ্চিত্র -
অমুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। তাই হয়তো যাওয়ার সময় পিছনে ফেলে গেছে। বাকি সবকিছু
আবর্জনাতে গেলেও এই খাতাটি যত্ন করে তুলে রেখেদিলাম পরে পড়ব বলে।
***************
আজ বেশ কদিন হল নতুন
কোয়ার্টারে। সব গুছিয়ে এসেছে। আজ তাই খেয়ে দেয়ে বসেছিলাম সেই চলচ্চিত্রের
পাণ্ডুলিপি নিয়ে। শুরুর দিকের ঘটনা বেশ পুরনো। তা প্রায় বছর ১৫ আগের। কোন এক
কলেজের কথা লেখা। লেখা সেই বয়েসের চাওয়া-পাওয়ার আবেগ গাথা।
*********************
২৫ নভেম্বর ২০০০
বেশ কটা মাস কেটেগেল এই
নতুন জায়গায়। র্যাগিং, ফ্রেশার্স সব চুকেবুকে গেছে। এখন আমরা দিব্বি ঘুরে বেড়াই
স্বাধীনভাবে। আমার হোস্টেলের রুমমেটের সাথেও আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। কলেজেও
বেশ কিছু বন্ধু হয়েছে। এই শহরটা খুব সুন্দর। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, ছিমছাম দোকান বাজার।
কলকাতার মত ভিড় নেই, অফিস-টাইম জ্যাম নেই। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মিষ্টি এক
নদী। বিকেল হলেই তার পাড়ে আমাদের আমোদ আর হুল্লোড়।
রোজ সকালে তাড়াহুড়ো করে
প্রাতঃরাশ সেরে দৌড় লাগাই আমরা বাস ধরতে। কলেজের বাস। আসলে আমাদের কলেজটা শহর থেকে
দূরে তো, তাই বাসে যেতে হয়। তারপর একটানা ক্লাস। উফ্… মাঝে মাঝে কি একঘেঁয়ে লাগে।
তাই তো এর মধ্যেই ক্লাস বাঙ্ক করাও শুরু করেছে অনেকে। ক্যান্টিনে আড্ডা বসে ওদের।
তবে আমার ঠিক ইচ্ছে করে না। বরাবর ভাল স্টুডেন্ট আমি। কত ভাল রেসাল্ট আমার! ক্লাস
ফাঁকি দেওয়া? না না। আমি দিই না। দুপুরে ফিরে এসে স্নান-খাওয়া সেরে আবার কলেজ।
আবার ক্লাস। তবে কোন এক ফাঁকে কাকার ঠেলাতে ফুচকা, কি খোকনের দোকানের চা বিস্কুটের
মজাই আলাদা।
আমার সবথেকে প্রিয় সময়
বিকেলবেলা। কলেজ থেকে ফিরে বন্ধুরা মিলে হোস্টেলের সামনে মাসির দোকানে দৌড়। গরম
গরম চপ চাই, কিম্বা বেগুনী। যেদিন যেটা মন চায়। দেরি হলেই মুশকিল, ফুরিয়ে যাবে।
এতগুলো মেয়ের চপের দাবী সামলানো কি সোজা কথা! এরপর চপ হাতে কোনদিন হাঁটা লাগাই ‘বেণীমাধব’
কোনদিন বা নদীরধার। সন্ধ্যে অব্দি হই-হুল্লোড় আর মস্তি।
আরে! বেণীমাধব লিখলাম,
নিজেই পরে বুঝতে পারব তো? বেণীমাধব এখানকার বাজার। একটা বড় লম্বাটে দোতলা বিল্ডিং।
তাতে খোপ-খোপ করে সারি সারি দোকান। যা চাই তাই পাই- এর একটা দারুন ব্যবস্থা। ওখানের
‘কাকার খাবার’ নামের রেস্টুরেন্টায় কয়েকবার খেয়েও এসেছি আমরা। ওখানের চিকেনচাঁপটা
এক কথায় অসাধারণ। এইতো কদিন আগে, ডিপার্টমেন্টের একজনের জন্মদিনে চুটিয়ে খেয়ে
এলাম। তবে বেশীরভাগ দিনই আমরা যাই নদীর ধারে। ঠাণ্ডা মিষ্টি হাওয়ার আদর খেতে।
*********************
এরপরে বেশ কিছু পাতা শুধু
হাবিজাবি হিসাব ভরা। কিছু পাতা ছেঁড়া। তাই পরের লেখাটা বেশ কয়েক মাস পরের।
*********************
২৭ মার্চ ২০০১
মাঝে অনেকগুলো দিন কেটে
গেছে। আমারও খুব একটা লেখার সময় হয় নাই।
মিড-সেমিস্টার, ক্লাস টেস্ট সামলাতেই হিমশিম। তারপর কলেজ ফেস্ট্। লেখার সময় ছিল
কই? জীবনে প্রথম কলেজ ফেস্ট্। দারুন একটা উত্তেজনা ছিল মনে। দারুন দারুন সাজগোজ
করেছিলাম সবাই। রাত অব্দি হৈ-হুল্লোড়। ব্যান্ডের গান হল। আমাদের সব থেকে প্রিয়
ব্যান্ড – চন্দ্রবিন্দু। এই প্রথম ব্যান্ডের লাইভ প্রোগ্রাম দেখলাম। শুধু একটাই
খারাপ লাগা। ও তো আমায় তেমন ভাবে ঘুরেও দেখল না!
কলেজে আসার কিছুদিন পর
থেকেই আমাদের পরিচয়। একই ডিপার্টমেন্টে আমরা পড়ি। ক্লাসে কথাও হয় অনেক। আমাদের
বন্ধুত্ব, বাকিদের সাথে ওর বন্ধুত্বের থেকে যে একটু আলাদা সেটাও সবাই বোঝে। তবু,
কেন জানিনা, ফেস্টের সময় ও তো ওর বন্ধুদের (ছেলে বন্ধু) সাথেই থাকল। আর ঐ অন্য
ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়েটার সাথে কথা বলল, গল্প করল, বেশ কিছুটা সময়ও কাটালো।
আমার খারাপ লেগেছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, খারাপ
লেগেছে। ঐ মেয়েটা কি এমন! দেখতেও ভাল না, রেসাল্ট কি কেঊ জানে না, তারমানে নিশ্চই তেমন
কিছুই না। ওর মতো একটা ছেলের পাশে ওই মেয়েকে মানায়? সত্যি, ওর মতো দেখতে ছেলে কম
হয়। যেমন রুপ, তেমন রঙ, তেমন বুদ্ধি। ওর পাশে আমাকেই মানায়। কিন্তু কিভাবে বলব
সেটা ওকে?
সামনে আবার ক্লাস টেস্ট
আছে। আজ আর লিখব না। একটু পড়তে বসি।
*********************
এরপরে প্রায় অর্ধেক খাতাই
খাপছাড়া বাহবে ছেঁড়া। যেন প্রচণ্ড রাগে কিম্বা যন্ত্রণায় কুচিয়ে ফেলতে চেয়েছে
নিজেকে, নিজের অস্তিত্বকে কিম্বা হয়তো ফেলে আসা অসহ্য অতীতকে! আধ ছেঁড়া একটা পাতায়
একটুকরো লেখা –
*********************
না, এটা ঠিক করল না। ও
আমায় ঠকাল। আমি তো আমার সেই ভাল লাগা ভুলে শুধু প্রদীপকেই ভালবেসেছিলাম। কিন্তু
প্রদীপ এটা কি করল! ওকে বিশ্বাস করেই তো ওর বাড়ি গিয়েছিলাম। ও তো বলে নাই ওর
বাবা-মা বাড়ি থাকবে না! আর এখন আমায় এড়িয়ে যাচ্ছে! কেন? কেন? কেন? কলেজে সবাই আমায়
নিয়ে মজা করছে। ওর বন্ধুদের ও সব কথা বলে দিল! কেন!
কে দেবে আমার…
*********************
এরপর আর কিছু নেই। একদম
শেষ দিকে খাপছাড়া তিনটে মাত্র পাতা ঠিকভাবে পড়া যাচ্ছে। কোন অলৌকিক যাদুতে যেন
সেটা থেকে গেছে খাতায়। একটায় তারিখও নেই। হয়তো সেটা সেদিনের লেখার শুরুটা নয়।
*********************
হোস্টেলটা বেশ ভাল। চাকরি
ছেড়ে এম.বি.এ পড়ার সিদ্ধান্তটা মনে হচ্ছে ঠিকই নিয়েছি। পুরনো সব গ্লানি কেটে গেছে
মন থেকে। এই ঝাঁ-চকচকে শহর, দারুন ক্যাম্পাস আর কি স্মার্ট সব ছেলেমেয়ে! খুব ভাল
আছি। জীবনটা এবার গুছিয়ে যাবে। মন দিয়ে পড়ব। ভাল একটা চাকরি পেতেই হবে। অভির পিএইচডি-ও
ততদিনে হয়ে যাবে। এবার বাড়ি গেলে ওর সাথে দেখা করব। এই চ্যাটে আর কতদিন প্রেম হবে!
ঐ অদ্ভুতভাবে আলাপ আর তার থেকে প্রেম। কি করে আর কবে যে হল! অভি খুব ভাল ছেলে।
আমারই বয়সী, তবু কি ম্যাচিওর। দুজনে মিলে জীবনটাকে নতুন করে সাজাব আমরা।
অভি বলেছে ওর আর এক বছর
লাগবে। তখন আমারও আর ৬ মাসই বাকি থাকবে। তাই কোন অসুবিধাই হবে না। একটাই চিন্তা,
বাড়িতে আবার কি বলে!! যাই বলুক, আমি বোঝাব।
এতদিন ধরে সবাই আমায় ঠকিয়েছে। এতদিনে সত্যিকারের প্রেম এল আমার জীবনে। নিজেকে
দারুন দারুন সুখী মনে হয় আজকাল।
আচ্ছা! মনে হয় বলছি কেন?
আমি কি সুখী নই? আমি তো সত্যি সুখী।
যাই, অভির সাথে চ্যাটের
সময় হয়েগেছে। ও বলেছে আজ আমায় নিয়ে একটা কবিতা লিখে পাঠাবে।
*********************
১২ সেপ্টেম্বর ২০১২
আমার জীবন কি শুধুই
প্রতারণার গল্প? কোন একজনও কি সত্যি হতে পারে না? অভিও শেষ অব্দি ঠকাল? বাবা-মা
ঠিকই বলেছে। আর এটাকে টানার মানে হয় না।
আজও ভাবতে পারছি না। এত
মিথ্যে? নিজের বয়স, কলেজ, অতীত সব এইভাবে মিথ্যে দিয়ে কেউ ঢাকতে পারে? পারে কেউ
এইভাবে মিথ্যে বলে কাউকে বিয়ে করতে? আর শেষ অব্দি কিনা অন্য একটা অচেনা মেয়ে আমার
বাবা-মাকে ফোন করে অপমান করছে! তার জীবন শেষ করে দেওয়ার জন্য আমাদের আজ দায়ি করছে!
আমি তো হঠাৎ অভিকে বিয়ে করিনাই। দু বছরের বেশি আমাদের আলাপ আর প্রেম। কই ও তো কখনও
অন্য কোন মেয়ের নাম আগে বলে নাই! আমাদের বিয়ে আমাদের দুজনের ইচ্ছেতেই হয়েছিল।
তাহলে এই মেয়েটি কেন বলছে আমি অভিকে কেড়ে নিয়েছি? কেন বলছে আমি আর আমার পরিবার
নাকি মেয়েটির জীবন শেষ করে দিয়েছি! সবই কেমন অদ্ভুত না??
আমার কাছে আজও পরিষ্কার
নয়, এই মেয়েটা কে? কেন ও বলছে, আমি ওদের জীবনে ঢুকেছি? কেন ও বলছে আমি ওর থেকে
অভিকে কেড়েছি? কে ও? কবে থেকে ওদের পরিচয়? এসব কিছুই তো বুঝতে পারছি না। অথচ অভিও
কোন প্রতিবাদ করছে না। বরং আমার থেকেই দূরে সরে গেল। হারিয়ে গেল অজানার সমুদ্রে। বিয়ে
ব্যাপারটা কি এতই ঠুনকো? এত সহজেই সেটা ভেঙ্গে
দেওয়া যায়! ভুলে যাওয়া যায় সব শপথ? কি জানি!
তবে রোজ রোজ বাবা-মাকে এই
ভাবে আর কষ্ট পেতে দেব না। আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেব। যে আমায় চায় না জোর করে তার
জীবনে থেকে কি লাভ!
*********************
২১ জুলাই ২০১৪
আজ আর একটু হলেই খাতাটা
তমালের হাতে পরত। এই খাতা এবার এমন জায়গায় রাখতে হবে, যাতে ভুলেও ওর হাতে না পরে।
কিন্তু সেটা কোথায়? ভাবতে হবে। এই খাতা হাতে পড়লেই হল আর কি! যা হিংসুটে! ‘কেন
পুরনো খাতা আজও বয়ে বেড়াচ্ছি?’ ‘আমি কি আজও কিছু ভুলতে পারি নাই?’ ‘সত্যি কি ওকে
ভালবাসি নাকি শুধুই কম্প্রোমাইস্?’ হাজারো প্রশ্নের ঝড় আর অহেতুক অশান্তি। না
বাবা! সামলে থাকতে হবে। তারপর ঐ কলেজের কথা তো ওকে আর সাহস করে বলিও নাই। বলার
ইচ্ছেও নেই। সত্যির থেকে আজও আমার কাছে শান্তি বড়।
আজ মনটাও একটু খারাপ।
উদাস উদাস লাগছে। বাড়ির জন্য, বাবা-মার জন্য মন কেমন করছে। কতদিন হয়ে গেল বাড়ি যাই
না। আপাতাত যাবও হবে না। ওখানে গেলেই সেই পুরনো কথা মনে করিয়ে দেয় উপকারি
প্রতিবেশি আর আত্মীয়রা। আর তমালকে নিয়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই। কি থেকে কি অশান্তি
যে বাঁধাবে! দেখা যাবে হয়তো আবার বিয়ে ভাঙছে।
আচ্ছা! এখন বিয়ে
বাঁচানোটাই যেন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে আমার। কিন্তু কেন? আমি কি এমন ভুল
করেছিলাম যে আজ আমার এই অবস্থা! কেন? কেন?
***********************
খাতাটা বন্ধ করে চুপ করে
বসেছিলাম অনেকক্ষণ। সত্যি, এই বিয়ে বাঁচানোর লড়াইটা আজও সমাজের আনাচে কানাচে হয়ে
চলেছে অবিরত সবার অলক্ষ্যে। আর এদিকে আমরা রকেট সায়েন্স থেকে ডিজিটাল মানি কত কিছু
ভেবে হল্লা করছি চায়ের আড্ডায়। কে খারাপ, কেন খারাপ সেটা বোঝা সম্ভব নয় এই খাতা থেকে।
এতে শুধুই একজনের ভাবনা লেখা। হতেই পারে আসল গল্পটা হয়তো অনেকটাই অন্যরকম। হতেই
পারে ভুল ছিল দু পক্ষ্যেই। কিন্তু এই সহজ সত্যটা সবারই জানা যে আজ এই মেয়েটির জীবন
‘বিয়ে সর্বস্ব’ হলেও ওকে ছেড়ে যাওয়া একটা ছেলেরও সেই সমস্যাটা নেই। কিন্তু কেন?
ভীষণ জরুরী এই ‘কেন’-র উত্তরটা খোঁজা।
----------------------------
গল্পটা এখানেই শেষ হতে
পারতো। আর তাই হয়েও ছিল প্রথমে। নিজের মতো গল্পটা লিখে জমা করেছিলাম কলেজের ম্যাগাজিনের
জন্য। এককালে এই কলেজেরই পড়েছিলাম; আর এখন এখানেরই শিক্ষিকা। তাই এখানে সবাই আমার
চেনা। আমাদের সময়ের আরো কিছু স্টুডেন্ট আমারই মতো ফিরে এসেছে এখানে শিক্ষকতা করতে;
কেউ অন্য চাকরি না পেয়ে, কেউ কলেজ বা শহরটাকে ভালবেসে। আমাদের এই কলেজটাও কলকাতা
থেকে দূরে একটা ছোট শান্ত শহরে। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, সাজানো বাজার আর শান্ত এক নদী –
এই সবই আছে এখানেও। বাইরে একটা কাকার দোকান, মাসির দোকান, খোকনের দোকানও মজুত।
আসলে এগুলো মনে হয় প্রায় সব কলেজের আশেপাশের চেনা ছবি। আমার লেখা গল্পটাকে তাই, আমাদেরই
কলেজের কথা বলে ভাবতে তেমন অসুবিধা হয় নাই কারো। তবে সেই মনে হওয়াটার পরেও আরো
অনেক আজগুবি মনে হওয়া যে জুড়ে যেতে পারে কেউ, তা ছিল আমার লেখক মনের কল্পনারও
অতীত।
গল্পটা জমা দেওয়ার কদিন
পরেই এক বন্ধু, যে কিনা এখন এখানেই অন্য বিভাগের শিক্ষক, আমায় আলাদা করে ডেকে নিয়ে
গেল। পরম মমতায় আর সমবেদনায় কাতর হয়ে উপদেশ দিল গল্পটা উইথ্ড্র করে নেওয়ার। অবাক
হয়ে কারন জানতে চেয়ে দেখি সে কি ভীষণ এক অস্বস্তি তার। পরিশেষে বহু কষ্টে,
একপ্রকার বেদনায় কুঁকড়ে গিয়ে বলল, - ‘দেখ কি হবে আর অতীত নিয়ে পরে থেকে? ভুলে যা
সব’।
-‘কার অতীত? কোন অতীত?
তার সাথে গল্পের কি সম্পর্ক?’
-‘দেখ সবাই তো তোকেই
খারাপ ভাববে, তাই না! কেন নিজের অতীত পাবলিক করছিস?’
আমি কোন ভাষা খুঁজে পাই
নাই। সত্যিই কি উত্তর দেওয়ার মতো কিছু ছিল? হ্যাঁ, জানি জায়গার বিবরণ ভীষণভাবে
মিলে যায়। মিলে যায় শহরের বাইরে থাকা কলেজটাও। কিন্তু গোটা গল্পে শুধু সেটাই
যথেষ্ট? যারা একসাথে পড়ল, এতগুলো বছর পাশে থাকল, তাদের এমন অদ্ভুত চিন্তাভাবনা? আমি
তো কলেজে পড়তে প্রেম করেছি। পুরো কলেজ জীবনটাই আমার প্রেমময় ছিল। কলেজের পরে সেই
প্রেম টেঁকেও নাই। বেচারা প্রেমিকটি আমার দাপটে হাঁসফাঁস করে ছেড়ে পালায় একটা
মিষ্টি, সুন্দরী, শান্ত মেয়ের কাছে। আমারও বিয়ে হয়ে গেছে আজ বেশ কয়েক বছর হল।
দিব্বি সুখে আছি দুজনায়। এই গল্পের সাথে সেই জীবনের মিল কোথায়? বরাবর ‘সাংঘাতিক’ এই
আমার থেকে ভয়ে তো সরেই থাকত অধিকাংশ ছেলে। আজকের এই দরদী বন্ধুর সেদিন সাহসও হত না
আমার সাথে মেশার। আজ কি সেটার বদলা নিতেই জেনে বুঝে অকারণ অপমান করে গেল আমায়!
কিন্তু পরে ধীরে ধীরে
বুঝলাম, বদলা নয়। ওদের মানসিকতাটাই আসল সমস্যা। আমার কলেজ জীবনটা পুরোটা জানা হওয়া
সত্ত্বেও বেশকিছু কমবয়সী শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে এই গল্পটাতে আমাকেই জোর করে মূখ্য
চরিত্র বানিয়ে দিয়েছে। অনেকে এসে এটাও বলেগেছে – ‘নিজেকেই ছেপে দিয়েছিস তো গল্পে’।
তাদের মুখ থেকে কথা ছড়িয়ে পড়েছে কাছে দূরে ছড়িয়ে থাকা বাকি পরিচিতদের মধ্যেও।
এমনকি বেশ কিছু স্টুডেন্টও এই নিয়ে আলোচনা, বা বলা ভালো সমালোচনা, করছে আনাচে
কানাচে।
‘সত্য সেলুকাস্, কি
বিচিত্র এই দেশ!’ আমি তুলে ধরতে চেয়েছিলাম ঘুণ ধরা সমাজের এক প্রচ্ছন্ন কিন্তু
প্রকট সমস্যাকে। কিন্তু এখন দেখছি ঘুণের গভীরতা আরো বেশী। গল্পে আমার তোলা
প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে খুঁজতে হবে অন্য এক সমস্যার সমাধান। বুঝতে হবে কেন আমরা
আশেপাশের মানুষকে অবিশ্বাস করতে ভালবাসি। কেন ভালবাসি চেনাজানা মানুষদের নামে
কেচ্ছা রটাতে, কিম্বা চেনা মানুষের কেচ্ছা শুনে তাতে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপদিই রসান্বেষণে।
কেন অন্যের চরিত্র কালিমা লিপ্ত দেখলে মনে একটা আনন্দ আর তৃপ্তির চোরা হিল্লোল
জাগে? কিসের মোহে আমরা আমাদের সব শিক্ষা, রুচি জলাঞ্জ্বলি দিয়েদিই এক মুহুর্তে?
আমরা কি সত্যিই শিক্ষিত? আমাদের সমাজ কি সত্যি মধ্যযুগীয় বর্বরতা পিছনে আসতে
পেরেছে? হিংসা, দ্বেষ, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের বর্বরতার হাত থেকে কি আদৌ মুক্তি
পেয়েছি আমরা? মুক্ত হয়েছে আমাদের মন ও মনন?
এই ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল
সামাজিকতা কি আমাদের কাছে বাইরের দুনিয়ার ভালগুলো এনে দিয়েছে? নাকি আমরা আমাদের
বাইরের দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের নিয়ে আরো ভাল করে ক্ষুদ্রতার চর্চা চালিয়ে
যাচ্ছি? দেশ বদলের বড় বড় স্ট্যাটাস আপডেট দিয়ে নিজেদের জ্ঞান জাহির করা আর গ্রুপ
চ্যাটে পরচর্চা, পরনিন্দা করা ছাড়া সত্যি কি কিছু আহরণ করছি আমরা বিজ্ঞানের এই দান
থেকে? আজ যেন আমার মনে হচ্ছে পরমানু বোমা মন্দ লোকের হাতে পড়েছে। তাই বিধ্বংসী ক্ষয়
আরো বেশী করে, আরো দ্রুততায় ছড়িয়ে পরছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। খুব তাড়াতাড়ি এর
একটা প্রতিকার না হলে সমাজের সাজানো শরীরটা গলে পচে ক্ষয়ে পড়তে শুরু করবে অচিরেই। বেড়িয়ে
আসবে অন্তঃসার শূন্য কাঠামোটা। ধীরে ধীরে ঝরে পরবে সেটাও। মিশে যাবে আনাদি অনন্তে।
সেই ধ্বংস থেকে রেহাই নেই আমাদের কারোরই। রেহাই নেই নষ্ট চরিত্র মেয়েটির, তাকে
ঠকিয়ে যাওয়া ছেলেগুলোর, অন্যের চরিত্রে অকারণ কালি ছেটান নির্বোধদের, সব শুনেও
প্রতিবাদ না করা নিরীহ মানুষগুলোর, সাতে পাঁচে না থাকা ভালো মানুষদের কিম্বা
আমাদের বাড়ির নিষ্পাপ শিশুগুলোর, পৃথিবীর কোন জটিলতাই যাদের নিষ্পাপ মন ছুঁতেও
পারে না। মানবজাতির সেই নিরঞ্জন থেকে মুক্তির পথ আজ কে দেখাবে আমাদের!! সমস্যা আজ
বড় গভীর। সমস্যা আজ আমাদের মনের অন্দর মহলে।
Comments
Post a Comment