শখের ছোটবেলা - ছোটবেলার শখ

মানুষ মানেই মন, মন মানেই ইচ্ছে। কিছুই ইচ্ছে নেই মনে - এটা যেমন হয় না, তেমন মন নেই এমন মানুষ ও হয়না। তবে কিনা ইচ্ছেগুলি রঙ্গীন থাকে ছোটবেলাতে। বড় হলেই যত বিপদ। সব সুন্দর রঙ্গীন ইচ্ছের ঘাড়ে পিঠে চেপে বসে নানা রকম লোভ।তখন আর সেগুলো আগের মতো থাকে না। বদলে কেমন যেন স্বার্থান্বেষী হয়ে যায়।
ছোটবেলা ব্যপারটাই আসলে দারুন। আকাশটা  হয় ভীষণ  উঁচু আর খুব নীল। গাছগুলো হয় মাথার উপর বিরাট বড় একটা ছাতা। খোলা মাঠ আর নরম মাটির টানে বইতে মনই বসেনা!বৃষ্টি হলে তো কথাই  নেই। কি করে বড়দের ফাঁকি দিয়ে একটু ভেজা যায়! জল ছপ  ছপ  ছাদ কিম্বা বালি পথ মেঠো কুলি। মাথায় একটা পেখে বা টোপা থাকলে তো কথাই নেই। আর যদি বৃষ্টি নামে ঠিক পুকুর ঘাটে  স্নানের সময়! উফফফ! ডুব দিয়ে চুপ করে জলের উপর টাপুর-টুপুর মিষ্টি সুরের তান। আর সেই যে গরম এর কাঠ ফাটা দুপুরে তেষ্টা মেটাতে শশা চুরি? ওহোওওওও ... সেকি ভোলা যায়!
এই রকম দারুন জীবন কি আর বড় হলে থাকে? উঁহু। থাকে না। এমনকি থাকতে চাইলেও কেউ থাকতে দেবে না। কারণ সবার থোড়ি ভালোলাগে এমন পাগল জীবন! মজা তো আছে, কিন্তু টাকা নেই, দামী দামী জিনিস নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, ছোট্ট বেলাতে কোনো দামী জিনিস আমাদের কাছে দামীই ছিলনা। কারণ আমাদের পছন্দ ছিল খোলা প্রকৃতির উদার মন। 
সেই ছোট বেলার মনটাকে আজ হঠাত মেন পরে গেল। সেই সঙ্গে মনে পরে গেল আমার বহু সাধের, বহু আদরের আর নিতান্ত গোপনীয় ইচ্ছেগুলোকে। এদের কে তো ভুলেই গেছিলাম প্রায়। অল্প স্বল্প একটা দুটো উঁকি দিত মাঝে মধ্যে মনের কোণে বটে, তবে তেমন ভাবে জমে বসে ছিল কি আর সেই ছেলেবেলার দিনগুলোর মতো? আজ মনে পরে গেল কি ভীষণ নাচ শেখার ইচ্ছে ছিল যেটা আজও হয়ে ওঠে নাই সময়ের অভাবে। ইচ্ছে ছিল সাঁতার শেখার। মাকে একবার ধরেও ছিলাম। তারপর ঠিক কেন যে হয় নাই মনে নেই। হয়ত বাবা তখন বাইরে কোথাও posted ছিল। তাই মা একা সামলে উঠতে পারে নাই। ইচ্ছে ছিল গাড়ি চালানো শেখার, ইচ্ছে ছিল পিয়ানো শেখার, ইচ্ছে ছিল পাহাড় টপকে পৌছে যাওয়ার নতুন এক স্বর্গের মতো সুন্দর নিঝুম নিরিবিলিতে। কি দারুন সব শখ না! এই বয়েসে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি নিজেকে, নিজের ছোটবেলাকে। নিজের শখগুলো কে ভেবে আজ নিজেরই খুব ভালো লাগছিল। এগুলো আমার তখনের শখ যখন আমি ছোট, স্কুলের uniform পরা ছটফটে এক মন। 
এখন ওই বয়েসের বাচ্চারা এই ভাবে ভাবে কিনা জানিনা। তবে আমাদের সময় অনেকেই এমন ছিল। এই সব শখের সাথে বড় হয়ে কে কি হবে -সে সব শখ তো ছিলই। তবে এই গুলো থেকেই মনে হয় মানুষ চেনা যায়। যেমন তেমন খুব ভালো মনের কেউ হলে নিশ্চয়ই চাইতো গরিবের সেবা করবে, বা সমাজের উপকারমূলক কিছু করবে। আবার যেমন আমি তেমন মানুষও চিনি, যারা এক্কেবারেই অন্য রকম। চিরকালই যাদের জীবনটা টাকার অঙ্কে কেতাগিরির হিসাব। তাদের listএ mobile, camera, laptop থেকে শুরু করে বিষয় সম্পত্তি কি নেই! ছোটবেলায় তাই তাদের শখ ছিল দামী কাপড়, দামী bag, খুব কেতা দুরস্ত হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়া। আমি তো এমন মানুষ ও চিনি, যে তাকে ছোটোবেলায় সবাই প্রিন্স বলত - ইটা ভেবে এখনো খুব গর্বিত, যদিও আদপে জীবনে প্রায় কিছুই করে উঠতে পারে নাই। বরং টাকা আর দামী জীবনের আনাকারী লোভে সুখ শান্তিটাই  খুইয়ে বসে আছে। 
আমার ও কি শখ হয় না দামী দু-একটা জিনিসের? তার জন্য আরো পড়াশোনা, আরো ভালো চাকুরী - এসব তো আমিও ভাবি। তবে না হলেও মনে দাগ কাটে না অথবা সে সবের লোভে নিজে কষ্ট করে অর্জন করার ইচ্ছেটাও  হারিয়ে যায়না। সব থেকে বড় কথা, এই ইচ্ছে গুলো খন স্থায়ী; কিন্তু আপাত ভুলে যাওয়া বাল্যকালের সরল ইচ্ছেগুলো কিন্তু আমার মনের সঙ্গী। তাই ভুলেও তাদের ভুলি নাই। আজও dance schoolএর নাম শুনলে মনটা আনচান করে, সুযোগ পেয়েই সাঁতার শিখতে ঝাঁপিয়ে পরেছি,গাড়ি চালানো তো এখন জলভাত। আমার মতো অলস নয়-নয় করে বেশ কটা পাহাড়ও ডিঙিয়ে এসেছে। হিমালয় তো এখন নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার। 
কেমন যেন নাক উঁচু লেখা হয়ে যাচ্ছে, না? কিন্তু আমি অনের কথাই বলছি। এই ইচ্ছেগুলো আমার ভীষণ প্রিয়। যেমন অনেকেই আমায় আমার গাড়ি নিয়ে কথা শোনায়, ওটা নাকি একটা ছোটো সস্তা গাড়ি। কিন্তু আমার দারুন লাগে গাড়িটা চালাতে। আসলে আমার লক্ষ্য চালানো, গাড়ির সৌন্দর্য্য নয়। চালনোর খাতিরে মাঝে মাঝে অন্য দামী গাড়ির নাম মাথায় আসে বটে, কিন্তু status বাড়াতে নয়। আমার মতো মানুষ কিছু কম নেই, কিন্তু তারা হয়ত আমার মতো করে বলেন না। আসলে বললেই নাকি সেটা অহংকার হয়ে যায়! কি বিপদ বলুন দেখি!
তবে আমার মজা লাগে ওই সব মানুষদের দেখে যারা চায় তো দামী দামী জিনিষ, সেই সব দেখিয়ে খুব বুকও  ফোলায় ; তারপর আবার আমায় দেখে আক্ষেপ করে তার এগুলো করা হলো না বলে। আমি বলি কি, সবাই বরং চোখ বুজে ছোটবেলার কথা ভাবুন। সেই সাধগুলোকে মনে করুন তখন যেগুলো রঙ্গীন হয়ে ভাসতো চোখে। তাহলেই সব ঝামেল মিটে যাবে। আমার এক বন্ধু আমায় বলল - আমার নাকি শুধু কিছু করার ইচ্ছে। শেখার ইচ্ছে। এমন নাকি হয় না! ইচ্ছে নাকি নানা জিনিস পাওয়ার হয়। 
কি জানি বাপু! টাকা দিয়ে কেনা জিনিসগুলো কি ঠিক পাওয়া? তার উপর তো আবার কত জনকে দেখি ধার দেনা করতে, কিম্বা বেশি টাকা বেতনের জন্য হন্যে হয়ে যেতে। এই সব করে কিছু কিনে আনলাম, আর তাতে শখ মিটল! শখ তো হবে এমন কিছুর যেটা মানুষের সত্তাটাকে পরিতৃপ্ত করবে অর্জনের আনন্দে। আর অর্জন করতে গেলে তো নিজেকেই সেটা কষ্ট করে সেটা পাওয়ার যোগ্য করে তুলতে হবে! তারপর সেটা একবার পেলে আর কখনো হারাবে না। mobileএর মতো খারাপ হয়ে যাবে না, গাড়ির মতো ৫ কি ১০ বছর পর বেছে দিতে হবে না, কিম্বা SLR cameraটার মতো খারাপ হওয়ার ভয় থাকবে না।
কি তাই নয় কি?

Comments

Popular posts from this blog

ক্ষয় আরও গভীরে

লক্ষ্মণ রেখা

নয়নতারা