বন্ধুত্ব

আজকাল কান্ড দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে সস্তা আর সহজ সম্পর্কের নাম "বন্ধুত্ব"। সবাই সবার বন্ধু হতে চায়। ঘরের অন্দর মহলে উঁকি দিন। বউদি-দেওর, বউমা-শ্বাশুড়ি, দুই জা, দুই ভাই, ভাই-বোন, দুই বোন, ননদ-বউদি, বাবা-ছেলে, মা-মেয়ে আর যা যা সম্পর্ক পারমুটেশন কম্বিনেশন করতে পারেন সবাই নাকি এখন বন্ধুর মত। সবাই সবার বন্ধু। বলছি তাহলে বিকেলে ঐ পাড়ার মাঠে যে আড্ডাটা হয় ওটা কাদের সাথে হয়? আমি তো জানতাম ওরাই বন্ধু!
- ওরা আর বাড়ির সবাই এক হয়ে গেল?
- উহুঁঃ!
- ওরা হল বাইরের বন্ধু। ওদের সাথে অতো মাখামাখি ভালো না। ওদের সব কথা বলতে যেওনা। কে কখন সুযোগ নেবে!
- সুযোগ নেবে? তবে বন্ধু কিসের!
- আরে বাবা, সব বন্ধু কি অতো বিশ্বস্ত হয়? তেমন বন্ধু তো হাতে গোনা।
- আচ্ছা, ওই যে বাড়িতে আজ সবাই বন্ধু, তা তারা সবাই বিশ্বস্ত তো?
- হাজার হোক তারা নিজের লোক। তবে সব সময়ই একটু বুঝে শুনে চলা ভাল, এই আর কি!
কি বন্ধুত্বের অবস্থা!

এবার দেখা যাক, স্কুল কলেজে কি চলছে। এখানে সবাই মোটামুটি সম বয়েসি। তাই যার সাথে যার মেলে মন, তারা একসাথে সারাক্ষণ। কেউ কেউ আবার সবার প্রিয়, সবাই তার বন্ধু। সবাই তার সাথে খেলতে চায়, গল্প করতে চায়। সেই দেখে আবার গুটি কয়েক হিংসুটেও জুটে গেছে তার কপালে। স্কুলে সমীকরণটা বেশ সহজ। কলেজে গিয়ে একটু জটিল। কিছু কিছু মন এতো দিনে একটু শেয়ানা হয়ে উঠেছে। কাকে কাকে হাতে রাখলে তেল দিলে সহজে ভালো নোটগুলো পাওয়া যাবে সেটা চুপচাপ ছকে নিয়েছে। তাই তাদের সাথে আগে একটা ভালো বন্ধু-বন্ধু ব্যপার বানিয়ে নিয়েছে। তারপর নিজের মনের মত কিছু বন্ধু জুটিয়ে দিব্যি মজায় আছে। কেউ কেউ আবার একটা প্রেম শুরু করেছে বেশ হিসাব করে। কারো হিসাব লোকাল, কারো গ্লোবাল। লোকাল হিসেবিরা জানে আপাতত রেসাল্টটা জরুরি, কিম্বা ফালতু খরচের টাকাটা। গ্লোবাল হিসাবটা আপাতত খুব সুবিধা দিক না দিক, ভবিষ্যত দেয় চকচকে। এদের মধ্যে যারা সাবধানী, তারা প্রেমটাকে প্রেম বলে আপমান করে না। বলে 'বিশেষ বন্ধু'। সেই বন্ধুর সাথে নাকি অনেক অনেক ক্লোজ্ হওয়া যায়। এই বিশেষ বন্ধুদের ব্যপারই আলাদা। পরে না পোষালে সম্পর্কের এই 'বিশেষ' বিশেষনটি বাদ দিলেই মুক্তি।

কাজের জায়গায় এই কলেজের ন্যাকামির আর একধাপ উন্নতি। সবাই সবার বন্ধু। বন্ধুর কাছে পার্টি চাই, বন্ধুর সাথে বেড়ানো চাই, বন্ধুর হাঁড়ির খবর চাই, শুধু বন্ধু বিপদে পড়লে দু-একজন ছাড়া সবাই নানা অনিবার্য কারণে কিছুতেই সময় না করতে পারার দুঃখ প্রকাশেই আশ্বথামা হত ইতি (গজ)। নিজের সুখ-দুঃখের কথা এদের বললে যে কোনদিন এরা সেটার সুযোগ নিয়ে আপনাকে ডোবাতে পারে; না হলেও আড়ালে হাসা-হাসি তো অনিবার্য। তবু এরাই বন্ধু। ভীষন বন্ধু। এদের ছাড়া আপনার জন্মদিনের পার্টি অপূর্ন; এমন কি আপনার বাচ্চার জন্মদিন কি মুখেভাতেও এরাই মুখ্য, আত্মীয়রা গৌণ্য। যদিও এক সময় তারাই আবার খুব বন্ধু ছিল।

আর একটা বিষয় তো সবারই জানা। বর-বউএর বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও আজকাল তাদের মধ্যে অনেকেই বন্ধুর মতো থেকে যায় একে অপরের জীবনে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের তো কথাই নেই। আজকাল তো ৬ মাসেই সম্পর্ক পুরনো হয়ে যায়। আবেগ ধুয়ে যায়, প্রেম মুছে যায়, আর তখনই ময়দানে এসে জোটে "বন্ধুত্ব"। 'আমরা বন্ধু হয়ে থাকব।'

সব দেখে শুনে, ছোটবেলার অঙ্ক করার কথা মনে পড়ে যায়। একটা কঠিন অঙ্কে আটকে গেলে, তার বদলে একটা সহজ অঙ্ক দেওয়া হত। 'বন্ধুত্ব' যেন তেমনই পৃথিবীর সব থেকে সহজ আর সস্তা সম্পর্ক। যে কোন একটা সম্পর্ক সামলাতে না পারলেই সেটা বদলে বন্ধু হয়ে যাও। আবেগ, শ্রদ্ধা, দায়িত্ব, ভালবাসা যাই কম পড়ুক, একটাই সমাধান -বন্ধুত্ব। যেন কোন চেতনাহীন এক আলাপন, চেনা-না চেনার মাঝের সুতো। বন্ধুত্ব যেন জগতের সব থেকে সস্তা পন্য।

Comments

Popular posts from this blog

ক্ষয় আরও গভীরে

লক্ষ্মণ রেখা

নয়নতারা