আমাদের ঝুলন

আমার ঝুলন মানেই বাগানের মাটি, টুনি বাল্ব আর দুই ভাইবোনের ছোট্ট স্বপ্নের রাজ্য

 



বর্ষা মানেই রথযাত্রা, বর্ষা মানেই ঝুলন, রাখি। রথের মেলা আর রাখি বানানো হয়তো আরো অনেক জায়গায় আছে। কিন্তু ঘরে ঘরে ছোটদের বানানো ঝুলন মনে হয় নিছকই বাংলার অন্দরমহলের সৃজনশীল মনগুলোর মিষ্টি বহিঃপ্রকাশ।

সে এক দারুণ আনন্দের সাত দিন। ঝুলনের আগের দিনটাই ছিল আসল মহাযজ্ঞের দিন। সেদিন বিকেলে খেলা উঠত মাথায়। স্কুল থেকে এসে, কোনমতে দুধ পাঁউরুটি খেয়েই শুরু হত তাণ্ডব। কাজের মাসির সাথে আমরা দুই ভাইবোন মিলে পাশের মাঠ যেতাম; সাথে একটা ইয়্যা বড় কোদাল। জায়গা আগের থেকেই বেছে রাখা থাকত।  একটা ফুলের মতো বড় ঘাস হ'ত এই সময়ে।  দেখে রাখতাম কোনটা বেশি ভালো। সেটাই নিতে হবে। আর তার সাথে আরও কিছু জায়গা বাছা থাকতো, যেখানে মাটিতে ঘাস হয়ে আছে খুব সুন্দর ভাবে।  জমির সেইসব বিশেষ অংশ থেকে চৌকো চৌকো মাটির চাকা তুলে আনা হত।  একটা নয়, বেশ কয়েকটা। পাশাপাশিই সেগুলো বসিয়ে তৈরি হত ঝুলনের জমি, সবুজ পটভূমি। মধ্যমণি হয়ে থাকত ফুলের মত ঘাসটা। 

আমাদের ঘরে ঢোকার মুখেই, সদর দরজার ডান দিকে ছিল একফালি জায়গা। সারা বছর খালি পড়ে থাকত। সেটাই বরাদ্দ ছিল আমাদের দুই ভাইবোনের ঝুলন বানানোর জন্য। মাটি সাজিয়ে দৌড় লাগাতাম বাগানে। এই গাছ, ওই পাতা, যা যা মনে ধরত সব তুলে এনে তৈরি হত বাগান, কখনো জঙ্গল। কখনো নদী বানিয়ে তার পারে বালি আর নুড়ি ছড়িয়ে দিতাম, গাছগুলো সরিয়ে দিতাম একটু দূরে। আবার কখনো পাহাড়-গুহা বানানোর চেষ্টা করতাম। সেটা অবশ্য আমরা তেমন পারতাম না। মাটিতে কাপড় ডুবিয়ে কীভাবে যে ব্যাপারটা হত সেটা কোনোদিন ঠিক রপ্ত হয়নি আমাদের। তবু চেষ্টা থামত না।

এরপর বাক্স খুলে বেরিয়ে আসতো প্লাস্টিকের হরেক রকম ছোট্ট ছোট্ট খেলনা। যার বেশিরভাগটাই বিনাকা দাঁতনের সাথে পাওয়া। এসবের জমানো শুরু আমাদের জন্মের আগে। কবে কখন বাবা শুরু করেছিল সে আমাদের জানা নেই।  কিন্তু সেই অজানা সময় থেকে সংরক্ষিত এরা। তার সাথে জুটে গেছে আমাদের হামাগুড়ি বেলার আরো কিছু খেলনা। তাই ঝাঁপির বপু নিতান্ত ছোট না।  ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ত হরেক রকম জীবজন্তু, গাছপালা, মাছ। রকমারি রঙ আর মাপের।  ছড়িয়ে পড়ত তারা ঘাস, ঝোপ, নদী, পাহাড়ের আনছে কানাচে।  

নিচে, ঘাসের উপর সব সাজানো হয়ে গেলে,  শুরু হত পেছনের দেয়াল থেকে ছোট ছোট ফুল পাতা-সহ ডাল ঝোলানো। রাধা কৃষ্ণের বালাই ছিল না। ওই ডালই ছিল আমাদের ঝুলনের দোলা, আর ফুলপাতা দিয়ে সাজানো সেই দেওয়ালটাই ছিল প্রেক্ষাপট। আমাদের বাড়িতে একটা হালকা গোপালী রঙের ফুরুস ফুলের গাছ ছিল, দারুণ মিষ্টি রঙ। এটা ছিল আমার সবথেকে প্রিয় গাছ।  আমিই কোথা থেকে যেন মাকে একটা ডাল ভেঙে এনে দিয়েছিলাম। সেটা পুঁতে দেওয়া হয়েছিল বাগানের পশ্চিমের দক্ষিণ কোনায়। সেই ডাল থেকে বছর ঘুরতে হয়ে গেছিল একটা ঝাঁকড়া ফুলে ভরা সুন্দর গাছ।  বাইরে থেকে, আমাদের বাড়িটা তখন ঠিক ছবিতে দেখা গোছানো বাংলোবাড়ি মনে হত। এ হল আমার মায়ের হাত আর মেদিনীপুরের মেদিনীর জাদু।  প্রতিবছর ঝুলনে, এই গোলাপি সুন্দরী থাকত পিছনের দেয়াল জুড়ে। তার সাথে জুটে যেত আরো কিছু কচি সবুজের ঝালর, ঝুলনের ঝলমলে রঙ্গিন প্রেক্ষাপট।  

সব কিছু হয়ে গেলে হাত পা ধুয়ে পড়তে যেতাম। আর অপেক্ষা করতাম বাবার ফেরার। কারণ টুনি বাল্ব লাগানোর দায়িত্ব ছিল বাবার। রাতে খাওয়ার আগে বাবার সঙ্গে আমরা দুই ভাইবোন মিলে লাগাতাম তুনি বাল্ব। তারপর যেই আলো জ্বলে উঠত, উফ্‌! আজও সেই আনন্দ ছুঁয়ে যায়। কী যে সেই আনন্দ, তা হয়তো কেউ বুঝবে না। দুই ভাইবোন হৈ হৈ করে উঠলাম।  বাবা মাও যোগ দিত।  সবাই মিলে নিজেরাই নিজেদের তারিফ করতাম। এখনের মত বোকা বোকা 'মুখবই' বা 'কি চলছে' ছিলনা সেই যুগে।  ফোন মানে তার ঝোলানো একটা বড় বাক্স। আন্তৰ্জাল নামটাই জানতাম না কেউ। তাই জীবন ছিল সহজ, খুশী ছিল নিজেদের মধ্যেই।যাইহোক, এসব করে রাতে ঘুমোতে গিয়ে মনে হত আমরা যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছি। এবার শুধু পরের দিনের বিকেলের অপেক্ষা।

পরদিন থেকে টানা সাত দিন চলত দল বেঁধে পাড়া ঘুরে ঘুরে সবার বাড়ির ঝুলন দেখা। কার কত ভালো হলো, কারটা ভালো নয়, সেই নিয়ে চলত আলোচনা আর গবেষণা। আমার প্রতিবারই মনটা একটু খারাপ হত, কারণ আমারটা কোনোদিনই ভালোদের দলে পড়ত না। এই ব্যাপারটায় আমি তেমন পোক্ত ছিলাম না। চেষ্টা প্রচুর করতাম, কিন্তু ফল বদল খুব একটা হত না। মাথার ওপর এক বড়ো দাদা বা দিদির অভাব তখন খুব টের পেতাম। কী আর করা যায়! তবে মজায় টান পড়ত না। এই কটা দিন খেলা খুব একটা হতো না। ঘুরে ঘুরে ঝুলন দেখা; কেউ কেউ আবার গেলে মিষ্টি দিত, আমাদের উপরি পাওনা। নিজেদের অজান্তেই কোথা দিয়ে যে কেটে যেতে একটা পুরো সপ্তাহ কেউ বুঝতেই পড়তাম না। 

রাখির পরের দিন সন্ধ্যেবেলায় সব খুলে ফেলা হত। খেলনাগুলো ধুয়ে মুছে আবার ঢুকিয়ে দেওয়া হতো তাদের বাক্সতে। ঘাস মাটি সব তুলে ফেলে দিতাম পাশের খালি জায়গাটাতে। কাজের মাসি, কেনিজা, ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিত জায়গাটা।  দুই ভাইবোন তখন মন খারাপটা সামলে নিতাম রাখির হিসেব কষে। কটা পেলাম, কোনটা কেমন, এসব নিয়েই তখন উত্তেজিত। সাথে পরের বছরের জন্য জল্পনা কল্পনা তো ছিলই। তার সাথে আরও জুড়ে যেত কদিন পরের স্বাধীনতা দিবসের পরিকল্পনা। কোথায় কবিতা প্রতিযোগিতা, কোথায় বসে আঁকো প্রতিযোগিতা- সেইসব তখন মাথায় ঘুরছে।  শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতিও। বাঙ্গালীর বারো মাসের তেরো পার্বন এভাবেই শেষের দুঃখ ভুলিয়ে দেয় শুরুর আনন্দে। 



Comments

  1. বেশ ভালো লাগলো লেখাগুলো ফেসবুকে লিখলে আরও বেশি রিচ পাবে

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ক্ষয় আরও গভীরে

লক্ষ্মণ রেখা

নয়নতারা