অভিজ্ঞতা


রুম থেকে বেরিয়ে, কোরিডোরে অপেক্ষা করছিলাম। আমার ছোটোখাটো পুতুল পুতুল রুমমেট দরজায় তালা লাগিয়ে আসছে। ঘর যখন সবার, তখন একা কেন সে পড়ে থাকে পিছনে? তাই যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। বাকি দুই রুমমেট ততক্ষনে এগিয়ে গেছে নিজেদের মত গল্প করতে করতে। এমনিতেও দুই মোটির মোটা মাথায় এসব সূক্ষ্ম ব্যপার ঢোকে না। কে একটু পিছনে রইল, কে সাথে, তাতে কি এত যায় আসে! হঠাৎ কথার মাঝে কথা উঠলে খেয়াল হবে, খোঁজ পড়বে। ওই দুটো ঐ রকমই; মনটা ভাল তবে ভাবনা চিন্তার দৌড় একটু কম।
আমাদের হোস্টেলে একমাত্র আমাদের রুমটাই বড়। এক্কেবারে ফাইভ সিটার (না ‘স্টার’ নয়)। আমরা চারজন থাকি আপাতাত। অন্য বিছানাটির জ্যান্ত অংশিদার না থাকলেও, দখলদার কম নেই। বালতি, মগ, সাবানজাতিয় সমস্ত বাথরুমের সরঞ্জাম বহাল তবিয়তে শুয়ে বসে থাকে সারা খাটজুরে। ব্যবহারিক যাতার্থতা বজায় রেখে নামকরনও হয়ে গেছে সেই বিছানার- টয়লেট বেড।
আগেই বলেছি, আমার তিন রুমমেটের মধ্যে দুই জনা মোটি আর যার জন্য অপেক্ষা সে বেঁটেখাটো পুতুল পুতুল। তিন জনের মধ্যে পুতুল পুতুলটি আমার বেশি প্রিয়। কারন ও নিরিহ, শান্ত; আমার সব অত্যাচার সহ্য করা যেন ওর ধর্ম আর কর্তব্য। তাছাড়াও ঐ একমাত্র পাবলিক যে আমার কবিতার মর্ম বোঝে। আসলে ও নিজেও যে লেখে! বাকি দুই মোটির তো মোটামাথা। দিন রাত কবিতা নিয়ে শুধুই পিছনে লাগে। 'কবি', 'কবি' বলে রাগায়, ছন্দ মন্দ করে দেয় খেপিয়ে। কত কি যে বলে! তবু ওদেরও রক্ষে নেই। দুই কবির সাথে থাকার ভোগান্তি ওদেরও ভুগতেই হয়। সময় অসময় কবিতা শুনতে ওরা বাধ্য। কবি হলেও আমি তো মোটেই নীরিহ বা হাবাগোবা নই। বরং আমার ভয়ে ওরা একটু আতঙ্কিতই থাকে। দুই মোটা আর এক পুতুলের দেশে আমি এক তালপাতার মাঝারি উচ্চতার তেজী গলা, মাথা গরম সেপাই; দন্ডমুন্ডের মাথা, তিন অসহায় রুমমেটের একমাত্র রক্ষাকর্তা (যদিও এটা নিতান্তই আমার ধারনা)। ভয়ে এবং ভক্তিতে তাই কবিতা শোনার সাজাটুকু তারা মাথা পেতেই নেয়।
এ হেন ডর্মি জগৎ কিন্তু অন্যদের হিংসার দেশ। এখানে সবাই আসে আমাদের আনন্দের ভাগিদার হতে। যদিওবাকিদের সাথে তখনও আমাদের তত আলাপ জমে নাই। কটাদিনই বা হয়েছে! তাই আমরা নিজেরা নিজেদের নিয়েই মগন। রোজ সকালে আমার ঠং ঠং হরলিক্স গোলা,পুতুল রানীর জ্ঞানী জ্ঞানী (যা আমাদের শুধুই পাকা পাকা মনে হত) কথা, এক মোটির বাড়ি ছেড়ে আসার প্যান প্যান কান্না, আর একজনের সাজুগুজুর জিনিষ নিয়ে হাজার বাহানা; সব মিলিয়ে মিশিয়ে আমরা তবু আমরাই। পরে যদিও বোঝা গিয়েছিল আসলে এগুলো সবই ছিল ছদ্মরূপ, তবু তখন আমরা তাই।
আমাদের মধ্যে ছোট বড় সবার কাছে সব জায়গায় সমান প্রিয় আমার এই পুতুল কবি। তার নরম স্বভাব আর শান্ত মনের একেবারে জয়জয়কার। এমন কি সিনিয়ররা ওকে রিগিংয়ের তালিকা থেকে অব্দি বাদ দিয়েছে ভালবেসে। আমাদের মধ্যে ওই সবথেকে শান্ত। মাঝে মাঝে বেশ ভারী ভারী কথা বললেও আমাদের ওকে বাচ্চাই মনে হয়। ওর মনটা যেন এখনও ঠিক আমাদের মত অভিজ্ঞ নয়।

সে যাইহোক, ফিরে আসি আগের কথায়।  আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম করিডোরে। পুতুল মামনির অপেক্ষায়। তালা লাগিয়ে এসে সে অবাক।
"তুই আমার জন্য দাঁড়িয়ে কেন?"
"একসাথে যাব বলে!"
"আজ দাঁড়ালি আমার মনে আশা জাগল। এরপর যখন দাঁড়াবি না, তখন আমার কষ্ট হবে।"
ঘাবড়িয়ে, অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। জীবনে প্রথম এমন কথা শুনলাম। মাথায় যেন কিছুই ঢুকল না।
আমাকে আরো অবাক করে সোজা ফতোয়া জারি হল- "আর কখনও দাঁড়াবি না"।
এর উত্তরে কি বলেছিলাম জানি না। তখন এত ম্যাচিওর আমি ছিলাম না। হয়ত বলেছিলাম- দাঁড়াব না কেন? রোজ দাঁড়াব, কিম্বা বলেছিলাম- রোজ আশা করার কি আছে? কি জানি কি বলেছিলাম! আজ মনে নেই। জানি যাকে বলেছিলাম সেও ভুলে গেছে সে কথা। কিন্তু ওর কথাগুলো আমি ভুলি নাই, থেকে গিয়েছিল মনের অগোচরে।
আজ প্রায় এক যুগ পরে, যখন আমি নিজেই আমার ছোট ভাইসম এক বন্ধুকে বকুনি দিই মনে আশা জাগানোর ভুল কর্মটি করার জন্য, তিরষ্কার করি প্রত্যাশা তৈরি করে তা না রাখতে পারার জন্য, তখন সব থেকে বেশি মনে পরে আমার সেই দিনের কথা। বুঝি জীবন এক অভিজ্ঞতা। যে যত বেশি ঘটনার মধ্যে দিয়ে যায় সেই জীবনটাকে চেনে তত বেশী। আজ আমি কেন আমার অতি প্রিয় বন্ধুটিকে ধমকাই সে শুধু আমি জানি। কত রকম কত প্রতারনা থেকে এই অভিজ্ঞতা তা বাইরে থেকে বোঝা দুস্কর। সেই সঙ্গে আজ বুঝি সেই দিনের সেই কথার মর্ম। বুঝি ওইটুকু বয়েসেই কতক্ষানি ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ঐ সরল মনকে যেতে হয়েছিল। কত বেশী যন্ত্রণা বা প্রতারনার শ্রীমুখ দর্শন করতে হয়েছিল ওকে ওই নরম সরম কবি মনকে।বুঝি তখন থেকেই সত্যি কতটা ও ভালবাসত আমাকে, আর ভয় পেত হারানোর। আজ নিজেকে দিয়ে চিনতে পারি সেদিনের সেই মনটাকে।



Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

ক্ষয় আরও গভীরে

লক্ষ্মণ রেখা

নয়নতারা